নবাগত এমবিবিএস ছাত্রছাত্রীদের প্রতি
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
আজ থেকে ৩৯ বছর আগে আমি তোমাদের মতই মহান চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। তোমরা আমার পেশা শিক্ষা করার জন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছ। তোমাদের স্বাগতম জানাচ্ছি। আমি এই পেশায় আসতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি এবং মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। তোমরাও এই পেশায় আসতে পেরেছ বলে নিজেকে ধন্য মনে করবে এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করে রেখেছিলে যে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কেউ কেউ হয়তো স্থির করেছিলে না। কেউ বা অন্য পেশায় যেতে চেয়েছিলে। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছায় এসেছো। কেউ বা বাবা-মা, দাদা-দাদী অথবা অন্য কারো ইচ্ছায় এই পেশায় এসেছো। যে কারনেই এসে থাকো সব ভুলে গিয়ে এখন একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছো এটা মনে করতে হবে। সেটা হলো দেশের এবং বিদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে রুগীর কষ্ট লাগব করবে। মনে রাখবে চিকিৎসা বিদ্যা হলো ছদগায়ে জারিয়ার মতো। তুমি চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসা দিয়ে রুগী ভালো করবে তার কল্যাণে তুমি সৃষ্টি কর্তার কাছ থেকে পুরস্কার পাবে। চিকিৎসা বিদ্যার শিক্ষক হয়ে যে শিক্ষা তোমার ছাত্রদের দিবে সেই শিক্ষার ফল সরূপ অনন্তকাল পুরস্কৃত হতে থাকবে। হাদিয়া সরূপ যে অর্থ তারা তোমাকে দিবে সেই অর্থে তোমার ইহকাল ভালো ভাবেই কেটে যাবে। কাজেই, মহান ব্রত নিয়ে কাজ করলে তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি পাবার সম্ভাবনা আছে। কিছু সংখ্যক চিকিৎসক আছেন তারা হয়তো সামাজিক কারনে হতাসাগ্রস্থ হয়ে চিকিৎসা পেশার প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য করে থাকতে পারেন। তাদের কথায় কান দিবে না। চিকিৎসা পেশায় যদি ত্রুটি থেকেও থাকে তোমরা ভবিষ্যৎ ডাক্তাররা তা দূর করে দিবে।
তোমরা এতদিন শিশু-কিশোর ছিলে। এখন যৌবনে পদার্পণ করেছো। এতদিন তোমাদেরকে মা-বাবা আগলিয়ে রেখেছেন। এখন তাদের থেকে তোমরা মুক্ত। এই মুক্ত পরিবেশে এসে তোমরা কেউ কেউ ভুল করে ফেলতে পারো। এখন তোমরা আমাদের হাওলায়। যতদূর পারি আমরাই তোমাদেরকে আগলিয়ে রাখবো। আমরাই তোমাদেরকে শ্বাসন করবো। আমরাই তোমাদেরকে আদর করব। বাবা মা থেকে যথেষ্ট আদর পেয়েছ। আর আদরের প্রয়োজন নেই। এই পাচ বছর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে ডাক্তার হিসাবে বের হয়ে বাবা মার ঋণ শোধ করবে। বাবা মা আত্বীয় স্বজন তথা সমাজের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করবে।
পরিপুর্ন ডাক্তার হতে তোমাদের পাচ বছর সময় লাগবে। তোমরা ছিলে সাধারণ ছাত্র। এখন থেকে মেডিকেলের ছাত্র। সাধারণ ছাত্র থেকে মেডিকেলের ছাত্রদের পার্থক্য আছে। তোমাদের পোষাকও আলাদা। এপ্রোন গায়ে দিয়ে যেমন বাহিরে সাদাসিদে তেমনি ভিতরেও তোমার সাদা থাকবে। চুলের স্টাইল, জামাকাপড় ও জুতার স্টাইল হবে মার্জিত। ক্লাসমেটদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরন করবে। বড়দের শ্রদ্ধা করবে। ছোটদের স্নেহ করবে। কোন কোন সিনিয়র ছাত্র গোপনে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের উপর র্যাগিং নামে একটা বাজে প্রাক্টিস করে থাকে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে। তবে এটা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে নাই। যদি কেউ এটা করেও থাকে তার রক্ষা নেই মেডিকেল কলেজের টিচারদের থেকে। মেডিকেলপ কলেজের ছাত্রদের পাস ফেল সরাসরি শিক্ষকদের হাতে। তবে অন্যায়ভাবে কাউকে পাস বা ফেল করানো হয় না। শিক্ষকগন বিভিন্ন মতাদর্শ অবলম্বন করলেও পরীক্ষা পাসের ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় আনেন না। তোমাদের মুল কাজ হবে মেডিকেলের পড়া পড়া। পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেনতা থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুদ্দ হয়ে দেশ সেবার সুষ্ঠধারার রাজনীতি করলে কোন ক্ষতি নাই। কোন ক্রমেই দুষ্ট ছাত্রদের পাল্লায় পড়ে ভ্রান্ত পথে পা দিবে না। এই পথে নেয়ার জন্য প্রথম দিকে তোমাকে অর্থের লোভ দেখাবে। এদের থেকে সাবধান থাকবে। নতুন পরিবেশে কোন কারনে কোন সমস্যায় পড়লে ভুলেও বাবা মাকে জানাবে না। শুধু জানাবে আমাদেরকে। আমরাই তোমার সকল সমস্যার সমাধান করতে পারি। বাবা মা নয়। তারা তোমার সমস্যার কথা শুনে শুধু কষ্টই পাবেন। কোন ভাবেই বাবা মাকে কষ্ট দিবে না। শুধু ভালো সংবাদগুলি মোবাইলে জানাবে।
ক্যাম্পাসে শালীনতার সাথে চলাফেরা করবে। শিক্ষক ও সিনিয়র সামনে পড়লে দাঁড়িয়ে সম্মান ও গ্রিটিং জানাবে। বেয়াদবের মতো মটর বাইকের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়াবে না। বাহিরের বখাটের সাথে আড্ডা দিবে না। সন্ধার পর ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করবে না। ধুমপান করবে না। মদ্যপান করবে না। নেশাখোররা আড্ডা দেয় এমন জায়গায় যাবে না। ক্লাসে টিচার ভুল করলে নম্রতার সাথে ইন্ডাইরেক্টলি শুধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। মনে রাখবে, টিচার ইজ অলওয়েজ রাইট।
নিয়মিত পড়া শেষ না করতে পারলে মহা সংকটে পড়ে যাবে। বন্ধুরা যদি তোমাকে ফেলে উপরের ক্লাসে উঠে যায় তুমি লাইনচুত হয়ে পড়বে। উপরে উঠা তোমার জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে। পাস মার্ক কিন্তু ৬০%। মনে রাখবে। ক্লাসে এটেন্ডেন্স থাকতে হবে কম পক্ষে ৭৫%।
লেখাপড়া করার পাশাপাশি আনন্দ ফুর্তিও করবে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করে। ডিবেটিং ক্লাবে ডিবেট করবে সুস্থ যুক্তি তর্ক চর্চা করার জন্য। মেডিসিন ক্লাব ও সন্ধানী ক্লাবের সদস্য হয়ে ছাত্র বয়স থেকে মানব সেবার লিডারশীপ শিক্ষা নিবে।
আমরা তোমাদেরকে তিনটি জিনিস শিক্ষা দিব – নলেজ, স্কিল ও এটিচুড। চিকিৎসা বিদ্যার সব জ্ঞান শিক্ষা দিব এই পাচ বছরে। হাতে কলমে রুগী পরীক্ষা করা শিক্ষা দিয়ে স্কিল শিখাব। এর ফাকে ফাকে শিক্ষা দিব এটিচুড। ডাক্তার-রুগীর সম্পর্ক সুন্দর হওয়ার এটিচুড শিখানো হবে চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
বর্তমান যুগ ডিজিটাল যুগ। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তোমাকেও ডিজিটাল হতে হবে। তা না হলে তুমি তোমার কলিগদের থেকে পিছিয়ে পড়বে। বিদেশী ডাক্তারদের সাথে প্রতিযোগীতায় তুমি পিছিয়ে পড়বে। কাজেই ওয়েব ব্রাউজিং, কনটেন্ট রাইটিং, ইমেইল, ফেইজবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহারে এক্সপার্ট হতে হবে।
শিক্ষা গ্রহন করার দায়িত্ব তোমার নিজের। শিক্ষকণ শুধু গাইড দিবেন। সব পড়া মুল টেক্সট বই থেকে পড়বে। শুধু নোট বই থেকে পড়ে পাস করলে তোমার সেই জ্ঞান স্থায়ী হবে না। ক্লাস টিচার যেসব টেক্সট বইয়ের নাম লিখে দিবেন সেইসব বই কিনবে। কিছু কিছু বইয়ের নাম টিচার লিখবেন না। সিনিয়র ছাত্রদের থেকে সেইসব বইয়ের নাম লিখে নিবে। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে টিচারগন যেসব উপদেশ দিবেন সেইসব উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।
পাচ বছর পর তুমি আর ছাত্র থাকবে না। হয়ে যাবে ডাক্তার। ডাক্তার মানুষ না। ডাক্তার মানুষের থেকেও উর্ধে অন্যরকম এক জাত। মানুষ প্রকৃত ডাক্তারের কাছে নিরাপদ। প্রকৃত ডাক্তার মানুষের কাছে বিশ্বস্ত। কাজেই প্রকৃত ডাক্তার হতে হবে। আমি ১৯৯২ সন থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। গত ২৭ বছর ধরে এমনি করে প্রতি বছর একটি করে ব্যাচ নবীন ছাত্র হিসাবে রিসিভ করছি আর একটি করে ব্যাচ নবীন ডাক্তার হিসাবে সম্বর্ধনা দিয়ে বের করে দিচ্ছি। আমার অনেক ছাত্র আজ ভালো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়ে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। দেখা হলে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। আরো দোয়া করতে বলে। আমি দোয়া করি যেন তোমরা প্রকৃত ডাক্তার হয়ে পাচ বছরের মধ্যেই বেরিয়ে যেতে পারো এবং আরো উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে পারো।
–
৬/১/২০১৯ ইং
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রাধান,
প্যাথলজি বিভাগ,
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ,
কিশোরগঞ্জ।
sadequel@yahoo.com